বুড়ি ও সওদাগরের আমানত


সবুজদিয়া গ্রামে এক সওদাগর বাস করতো। সে বাণিজ্য করতে দূর দেশে যাবে। তার কাছে কিছু সোনার মোহর ছিলো। সেই গ্রামে তার আপন বলতে কেউ নেই। যারা ছিলো তাদের ওপর সওদাগরের কোন আস্থা ছিলো না। মোহরগুলো কোথায় রেখে যাবে এই নিয়ে মহা দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। পরে খুব চিন্তাভাবনা করে বের করলো। পাশের বাড়িতে বুড়িমা আছে। খুবই ভালো মানুষ।

ঈমানদার। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে। রোজা পালন করে। তার কাছে রাখা যেতে পারে। সে আমানতের কোন দিনও খেয়ানত করবে না। পরদিন সে বুড়িমার কাছে গেল এবং বলল ‘বুড়িমা এই পুঁটলিটা একটু যত্ন করে গুপ্তস্থানে লুকিয়ে রাখবে। আমি দূর দেশে সওদা করতে যাচ্ছি। ফিরতে ছয় মাস সময় লেগে যাবে। ফিরে এসে তোমার কাছ থেকে আমার আমানতের জিনিস আমি ফেরত নিবো।’ বুড়ি মা বললো: ‘ঠিক আছে বাবা, আমি বেঁচে থাকতে তোমার এই জিনিস কাউকে ধরতে দেবো না।’ সওদাগর এবার নিশ্চিন্তে বাণিজ্য করতে চলে যায়। সওদাগর যাবার কিছুদিন পরই বুড়িমা অসুস্থ হয়ে পড়ে। দিন যায় রাত যায় বুড়িমার অসুখটা বেড়েই চলে।

বুড়িমার খুবই কষ্ট। দিন দিন কষ্ট আরো বেড়ে যায়। বুড়িমা সওদাগরের এই আমানতের জিনিস নিয়ে মহা দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। বুড়িমা বুঝতে পারে যে তার মৃত্যু তার কাছে এসে পড়েছে। আপন জন বলতে বুড়িমার কেউ এই গ্রামে ছিলো না। কার কাছে রেখে যাবে এই আমানত। পরে চিন্তা-ভাবনা করলো, এই গ্রামের মোড়লের তো অনেক ধন সম্পদ আছে। সেএগুলোর প্রতি লোভ করবে না।

এখানেতো সামান্য কয়েকটি পিতলের পয়সা মনে হয়। সেদিনই অসুস্থ শরীর নিয়ে মোড়লের কাছে গেলো এবং বললো : ‘বাবা, আমি তো মরে যাবো তুমি আমার একটা কথা রাখবে বাবা।’মোড়ল বলল : ‘কি কথা বুড়িমা?

বুড়িমা বলল : ‘আমার এই পুঁটলিটা তোমার কাছে আমানত হিসেবে রাখতে হবে।

এই পুঁটলিটার মালিক পাশের বাড়ির সওদাগর। সওদাগর এলে তার হাতে তুমি নিজ দায়িত্বে তুলে দেবে বাবা।

আমার একথাটা তোমার রাখতে হবে।’ ঠিক আছে বুড়িমা, ঐ সিন্ধুকটায় ভালো করে ভরে রাখবো।’ বুড়িমা সুন্দর করে নিজ হাতে ঐ সওদাগরের সিন্ধুকে ওই পুঁটলিটা রেখে দিলো। বুড়িমা জানতো না ঐ পুঁটলিটাতে কী আছে। বুড়িমা মোড়লের কাছ থেকে বিদায় নিয়েচলে আসে। সে দিন রাতেই বুড়িমা মারা গেলো। মোড়লের মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি চাপলো। বুড়িমা মারা যাবার পাঁচ দিন পার না হতেই মোড়ল বুড়িমার সেই পুঁটলিটা খুলে ফেললো। পুঁটলিটা খুলেই মোড়ল হতভম্ব। খুশিতে রোশনাই তার চেহারা। সে তো ভীষণ অবাক পুঁটলিটার ভেতর দামি দামি সোনার মোহর যা মোড়ল জীবনে কখনও দেখেনি। এবার মোড়লের সেগুলোর প্রতি লোভ হলো। সে মনে মনে হাসতে থাকে। পুঁটলিটার দিকে লোভনীয় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলতে থাকে ‘বুড়ি মরেছে ভালোই হয়েছে। এখন এই মোহর আমার হয়ে গেলো।’

ছয় মাস পর সওদাগর ফিরে এলো। বুড়িমার খোঁজ করতেই জানতে পারলো বুড়িমা মারা গিয়েছে অনেকদিন আগে। সে বুড়িমার জন্য বড় দুঃখ প্রকাশ করলো। আল্লাহতায়ালা তাকে জান্নাতবাসী করুক বলে দোয়া করলো। কিন্তু বুড়িমা তার পুঁটলিটা কোথায় রেখে গিয়েছে। সে বুড়ির ঘরটায় অনেক তল্লাশি করলো। কোথাও খুঁজে পেলনা তার সেই পুঁটলিটা। সওদাগর এবার চিন্তিত হয়ে পড়লো। চিন্তায় চিন্তায় পাগল হবার পালা। কারণ সে সারা জীবন কষ্ট করেএই সম্পদ অর্জন করেছে। সে মনে মনেগভীর ভাবে চিন্তা করে বুঝতে পারলো। বুড়িমা খুব বুদ্ধিমতী ও সৎ ছিলো নিশ্চয়ই এই পুঁটলিটা কারো কাছে রেখে গিয়েছে। এবং বলে গিয়েছে আমার আমানত আমার হাতে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য। যার কাছে রেখে গিয়েছে সে নিশ্চয় ওয়াদার বর-খেলাপ করেছে। সে আরো ভালো ভাবে খোঁজ খবর নিয়ে দেখে বুড়িমা যেদিন মারা যায় সেদিন সকালে বুড়িমা মোড়লের বাসায় গিয়েছিলো। তার হাতে একটা পুঁটলি ছিলো।

কথাটা শোনা মাত্রই সে মোড়লের কাছে ছুটে যায় এবং মোড়লকে সকল ঘটনা খুলে বলে। মোড়ল হাসতে হাসতে সব অস্বীকার করলো। সওদাগর তাকে দুর দুর করে তাড়িয়ে দিলো। সওদাগর মনে মনে ভাবলো- আমার এই সম্পদ যদি কষ্টের ও হালালের হয়ে থাকে তবে আল্লাহর ইচ্ছায় আমি একদিন না একদিন এই আমানত ফিরে পাবোই। মনের দুঃখে সওদাগর প্রায়ই বুড়িমার কবরের কাছে গিয়ে কাঁদে। একদিন সওদাগর স্বপ্নে দেখে বুড়িমা তাকে বলছে, ‘সওদাগর তুমি আর কেঁদ না। আমার সাথে বেঈমানি করেছে মোড়ল। আমানতের জিনিস খেয়ানত করেছে। এই জন্য সে মারাত্মক শাস্তি ভোগ করবে। তোমার জিনিস যদি হালালের সৎ উপার্জন হয়ে থাকে তবে সেটা অবশ্যই ফেরত পাবে।’ সওদাগর এবার যেন কিছুটা সান্ত্বনা খুঁজে পেলো। দেখতে দেখতে অনেক দিন পার হয়ে যায়।

একদিন শুনতে পেলো মোড়ল এক কঠিন ভয়াবহ রোগে আক্রান্ত হয়েছে। কত দেশের কত কবিরাজ এলো ডাক্তার এলো। কেউই কোন রোগ ধরতে পারলো না। মোড়লের ধন সম্পদ আস্তে আস্তে কমতে কমতে ভীষণ খারাপ অবস্থা হতে থাকে। শেষমেশ সেই পুঁটলিটার ওপর নজর পড়লো। সেদিন রাতে মোড়ল যেই ওটাকে বের করবে ঠিক সেই মুহূর্তে ডাকাত পড়লো মোড়লের বাড়িতে। ডাকাতরা তারসব ধন সম্পদের দলিল বের করে টিপসই নিলো মোড়লের। সাথে নিলো সেই পুঁটলিটা। ঠিক সেদিনই সওদাগর আবার বুড়িমার কবরের কাছে গিয়ে কাঁদতে থাকে আর বলতে থাকে আমার মেয়ের বিয়ের জন্য পুঁটলিটা রেখে ছিলাম আমার মেয়ে বড় হয়েছে তার বিয়ে হচ্ছে না টাকার জন্য। গ্রামের মোড়ল আমার এই আমানতের জিনিস খেয়ানত করেছে আমি আল্লাহর কাছে অভিশাপ দিচ্ছি যে আমার এই পুঁটলিটা আটকিয়ে রেখেছে তার যেন ভয়াবহ কঠিক অসুখ হয়। পৃথিবীর কোন ডাক্তার কবিরাজ তাকে ভালো করতে পারবে না।

বুড়িমার কবরের পাশে ছিলো একটা বড় বটগাছ। সেই বট গাছের নিচে বসে ডাকাতি করা লুটের জিনিস ভাগ যোগ করছিলো ডাকাতরা ডাকাতদের সর্দার হঠাৎ সেই সওদাগরের এই করুণ আর্তনাদ শুনেফেলে। সেমনে মনে চিন্তা করলো তাইতো এই পুঁটলিটা ঐ সওদাগরের। এ পুঁটলিটা চুরি করার জন্য মোড়ল আজ কঠিন ভয়াবহ অসুখে ভুগছে। তার ধনসম্পদ সব গোল্লায় গেছে। আমরা তার পুঁটলিটা ফেরত দিয়ে দেই, নইলে আমাদের ওপরও তার এই অভিশাপ লাগবে। সাথে সাথে ডাকাতদের সর্দার ডাকাতদের সব ঘটনা খুলে বলে। মোড়লের এই করুণ পরিণতির কথা সবাই বুঝতে পারে। ডাকাতদের সর্দার ঐ পুঁটলিটা সওদাগরের কাছে নিয়ে যায় এবং বলে ভাই সওদাগর আমরা বুঝে গেছি, মানুষের সৎ হালালের পয়সা কখনো হজম করা যায় না।

এই নাও তোমার সোনার মোহরের পুঁটলিটা। তুমি তোমার মেয়ের বিয়ে দাও ধুমধাম করে। আর আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা আর কখনো ডাকাতি করবো না।’ সব ডাকাতকে বিয়ের দাওয়াত দিলো সওদাগর। সওদাগরের মেয়ের বিয়েতে আসার নিমন্ত্রণ পেয়ে ডাকাতরা মহা খুশি হলো। সওদাগর ধুমধামকরে মেয়ের বিয়ে দিলো। সওদাগরের খুশির সীমা রইলো না।

No comments